ডায়েট/ক্রাশ ডায়েট
"শরীরের নাম মহাশয়, যাহা সহাই তাহা সয়"- ব্যাপারটা কি আসলেই এমন? আসলেই কি শরীরকে যা সইতে বলব, সইবে? হ্যাঁ, প্রথম প্রথম হয়ত তাই মনে হবে। কিন্তু ক্ষত হবে গভীরে, যা আর সারবে না। আমরা নিজেরা এখন অনেক স্বাস্থ্য সচেতন। জিম করি, ডায়েট করি, ক্রাশ ডায়েট করি। ৫ দিনে ওজন কমাই ২ কেজি। আমরা কি চিন্তা করি, শরীরের উপর দিয়ে কি যায়? প্রতিদিন যে নিয়মে সূর্য উঠে আর অস্ত যায়, সেরকম শরীরেরও একটা নিয়ম আছে। শরীর ও একটা নির্দিষ্ট রুটিনে অভ্যস্ত হয়ে যায় এবং সেই রুটিন মাফিক থাকতে চায়। যে মানুষ প্রতিদিন ৩ বেলা ভাত, আর স্ন্যাক্স এ পিজ্জা/বার্গার খায়, সে যদি হঠাৎ করে একদিন অল্প কিছু ফল খেয়ে থাকে, তাহলে শরীরের কি অবস্থা হবে? ধরি, আমি সালোয়ার কামিজ পরি/শাড়ি পরি সবসময়। হঠাৎ একদিন শর্ট স্কার্ট পরলাম, আমার আসে পাশের মানুষ অবাক হবে না? বিব্রত হবে না? ঠিক, প্রতিদিন ভাত/পিজ্জা/বার্গার দেখে অভ্যস্ত পেট যখন একদিন শুধু ফল দেখে, তখন পেটেরও একই অবস্থা হয়। পেট অবাক হয়, বিব্রত হয়।
ক্রাশ ডায়েটের শুরুঃ
আমি ২০১৪ সালে ১ মাস জিম করেছিলাম (কোন জিম বলব না সঙ্গত কারণেই)। শুরুতেই, জিমের ইন্সট্রাক্টরকে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, আমার এক সপ্তাহে কেমন ওজন কমবে? উনি আমাকে বলেছিলেন, ৫ কেজি পর্যন্তও কমানো যায়। আমি তো প্রবল উৎসাহ নিয়ে জিম শুরু করি। যদিও প্রথম দিন করার পর কষ্টে মনে হচ্ছিল, আর যাব না। কিন্তু না, মনোবল এক করে আবার গেলাম। একসপ্তাহ পর যখন দেখলাম ওজন যা ছিল তাই আছে, আমার ইন্সট্রাক্টর কে জিজ্ঞেস করলাম, ওজন কেন কমলো না। উনি আমাকে বললেন, তুমি তো ডায়েট কর নাই। জিম করে ডায়েট না করলে ওজন আরো বেড়ে যায়! তুমি ক্রাশ ডায়েট কর!!! উনি আমাকে বেশ কয়েকবার বলেছেন এরপর ক্রাশ ডায়েট করতে। আমি মনেমনে বলি, ক্রাশ ডায়েট করলে তো আমি বাসায় বসেই ওজন কমাতে পারি, জিমে কেন আসলাম!
না, এক সপ্তাহ জিম করে যে ৫ কেজি কমে না আমি তা বলছি না। হয়তো কমে, কিন্তু তার সাথে অনেক ডেডিকেশন লাগবে, লাগবে বহুল অভিজ্ঞ ইন্সট্রাক্টর আর সাথে এক্সপার্টের দেওয়া ডায়েট চার্ট। তারপরও সেটা অর্জন করতে অনেক কষ্ট করতে হবে। আর কোন জিমের ইন্সট্রাক্টর যদি ক্রাশ ডায়েট করতে উৎসাহ দেয়, আমি বলব সে জিমে যেয়ে আমাদের যাই হোক, ভাল কিছু হবে না। কারণ, ক্রাশ ডায়েট কখনোই আমাদের শরীরের জন্য ভাল নয়। শুধু জিম করে ওজন কমাতে আসলে অনেক সময় লাগে, আর লাগে ধৈর্য্য। ওজন কমাতে পরিমিত খাবারের অবদান অনেক বেশি, আর জিম সাহায্য করে শরীরটাকে ভাল একটা শেইপে আনতে।
অতঃপর এক্সপার্টের কাছে-
২০১৫ সালের শুরুর দিকে নানাবিধ পরীক্ষা নিরীক্ষা করে ডাক্তার দের শরণাপন্ন হলাম। তারা বললেন, ওজন কমাও, বয়স কত! এই বয়সে এত ওজন!! তো ২০১৫ সালের মাঝামাঝি আমি সিদ্ধান্ত নিলাম যে, এবার একজন এক্সপার্টের কাছে যাব। আমাকে অনেকেই অনেক ডায়েটিশিয়ান সাজেস্ট করেছিল, যারা নাকি ওজন কমানোর ঔষুধ দেয়(লোভনীয় অফার)। যাই নাই, ওষুধ খেয়ে ওজন কমানোর ব্যাপারটাই আমার হজম হয় নাই আসলে। যাই হোক, আমি ঢাকা শহরের নামকরা(!) এক হাসপাতালের এক ডায়েটিশিয়ানের কাছে গেলাম। মাসখানেক পর রোযা, তিনি আমাকে রোযার চার্ট দিলেন, সাথে সাপলিমেন্ট(সেই ১৯০০টাকা মুল্যের সাপলিমেন্ট এখনও বাসায় আছে, দাম বেশি, তাই ফেলে দিতে মায়া লাগে)। সে ডায়েট আমার ভালো লাগে নাই, রেগুলার মেইনটেইন করতেও তাই খুব কষ্ট হত। যথারীতি ওজনও একই। পরে জেনেছিলাম, সাপ্লিমেন্ট গুলো খাওয়া আসলে ঠিক না, যেমন হরলিক্স।
নিজেই যখন ডায়েটিশিয়ান...
২০১৫ এর শেষের দিকে মনে হল, আমি নিজেই তো জানি কিভাবে ওজন কমানো যায়। কার্বোহাইড্রেট বাদ দিতে হবে, আর যতটা সম্ভব কম ক্যালরি খাওয়া যায়। চিনি/ফাস্টফুড/কোল্ডড্রিংক্স তো এক্কেরে বাদ। শুরু করলাম ডায়েট, সকালে স্কিম মিল্কে ওটস(তাও নামে মাত্র, ২/৩ টেবিল চামচ)। দুপুরে এক বাটি চিকেন/ভেজিটেবল স্যুপ(স্যুপ না বলে ১ টুকরা মুরগি, ২/৩ টুকরা সবজি আর লবন দিয়ে সিদ্ধ করা পানি বলা ভাল), রাতেও তাই। আর রাতে গ্রীন টি। ওজন ও কমলো, ২ সপ্তাহে ৭ কেজি। আমি স্যাটিস্ফাইড। কিন্তু এরপর শুরু হল আসল খেলা। হাঁটতে গেলে মাথায় চক্কর দিত, সিঁড়ি দিয়ে উঠতে গেলে পা টলমল করত। প্রেসার লো। হাত-পা চোখ হলুদ হয়ে গেল প্রয়োজনীয় নিউট্রিশনের অভাবে। খাবার দেখলেই গা গুলিয়ে আসতো। আমার আম্মাজান বললেন, অনেক হইসে, এভাবে না খেয়ে জন্ডিস বাধানোর কোন মানেই নাই। এগুলা আর চলবে না। আমি অসুখ বলতে ৩/৪ বার জ্বরে ভুগেছি সারা জীবনে, আর মাঝে মধ্যে পেটের সমস্যা। জন্ডিসের কথা শুনে ভয় পেলাম। না, এসব ডায়েটে আমি আর নাই বাবা! ১০৯ থেকে ১০২, আবার সেই ১০৯...
ডায়েট কি ক্ষতি করলো আমার?
আমার ওজন ১০০ কেজি হয়েছিল ২০০৯ সালে। ২০০৯ থেকে ২০১৫, ৬ বছরে ৯ কেজি ওজন বেড়েছে, আমি ১০৯ কেজি হয়েছি। কিন্তু ২০১৫ সালে ২ সপ্তাহ ডায়েট করে ৭ কেজি কমানোর পর ডায়েট যখন বাদ দিলাম, আমার সেই ৭ কেজি ওজন বাড়তে লেগেছিল ২ মাসের ও কম সময়। খেয়েছি বেশি? মোটেও না, বরং সচেতন ছিলাম আগের থেকে, তাই কম খেয়েছি। তাহলে কি হয়েছিল? এ ভয়াবহ ডায়েটের কারণে আমার মেটাবোলিজম এর যাচ্ছেতাই অবস্থা হয়েছিল। যা আমার ওজন বাড়ার হারকে বাড়িয়ে দিয়েছিল। সাথে সাথে আমার মেয়েলি সমস্যার ও কোন সমাধান হয় নাই। আর এত ওজনের জন্য আমি কোন কাজ/ হাঁটাচলা কিছুই করতে পারতাম না। দুই মিনিট হেঁটেই ক্লান্তি, পায়ে ব্যাথা, সিঁড়ি দিয়ে উঠলে হাঁটু ব্যাথা আর রাতে পায়ের তালুতে যন্ত্রনা, ঘুমই আসতো না!
আসলে এ ধরনের সিরিয়াস ডায়েট, যেমন ক্রাশ ডায়েট, জি এম ডায়েট, যেকোন ডায়েট যেগুলো কম সময়ে অনেক ওজন কমায়, আমাদের শরীরের জন্য ভাল না। বরং এগুলো আমাদের ডাইজেস্টিভ সিস্টেমের উপর, আমাদের মেটাবোলিজমের উপর খুবই খারাপ প্রভাব ফেলে। ওজন খুব তাড়াতাড়ি কমে, এটা ঠিক। কিন্তু এর পরে ওজন বাড়েও অনেক তাড়াতাড়ি, কারণ মেটাবোলিজম অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই যে কোন ডায়েটই আস্তে আস্তে শুরু করা উচিৎ, যেন আমাদের শরীর তাতে অভ্যস্ত হওয়ার সু্যোগ পায়। তাহলে যেমন আমাদের মেটাবোলিজমও ভাল থাকবে, আবার নির্ধারিত অজনে পৌছানোর পর ডায়েট বাদ দিলে আমাদের ওজন হূহূ করে বেড়ে যাবে না। আর কিছু সময়ের জন্য ডায়েট চার্ট মেইনটেইন না করে আমাদের সবসময়ই উচিৎ স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া। অর্থাৎ আমাদের খাদ্যাভ্যাসই পরিবর্তন করা।
আসলে এ ধরনের সিরিয়াস ডায়েট, যেমন ক্রাশ ডায়েট, জি এম ডায়েট, যেকোন ডায়েট যেগুলো কম সময়ে অনেক ওজন কমায়, আমাদের শরীরের জন্য ভাল না। বরং এগুলো আমাদের ডাইজেস্টিভ সিস্টেমের উপর, আমাদের মেটাবোলিজমের উপর খুবই খারাপ প্রভাব ফেলে। ওজন খুব তাড়াতাড়ি কমে, এটা ঠিক। কিন্তু এর পরে ওজন বাড়েও অনেক তাড়াতাড়ি, কারণ মেটাবোলিজম অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই যে কোন ডায়েটই আস্তে আস্তে শুরু করা উচিৎ, যেন আমাদের শরীর তাতে অভ্যস্ত হওয়ার সু্যোগ পায়। তাহলে যেমন আমাদের মেটাবোলিজমও ভাল থাকবে, আবার নির্ধারিত অজনে পৌছানোর পর ডায়েট বাদ দিলে আমাদের ওজন হূহূ করে বেড়ে যাবে না। আর কিছু সময়ের জন্য ডায়েট চার্ট মেইনটেইন না করে আমাদের সবসময়ই উচিৎ স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া। অর্থাৎ আমাদের খাদ্যাভ্যাসই পরিবর্তন করা।
এরপর,
নানাবিধ অভিজ্ঞতার পর বুঝলাম, ওজন কমানোটা দরকার সুস্থ্য থাকার জন্য, শুকানোর (নিজেকে আকর্ষনীয় করার) জন্য না। আর, আমাদের শরীরের মেদগুলো থাকার সুযোগ তো আমরাই করে দিচ্ছি প্রতিনিয়ত। বাইরে খাওয়া, বেশি বেশি চিনি, কোল্ডড্রিংক্স, মেয়োনেইজ, চিকেন ফ্রাই, চিজ, পিজ্জা, পাস্তা, আর বাসায় অতিরিক্ত ভাত(আমি ভাত খেতে অনেক পছন্দ করি, আর অনেক খাই) ইত্যাদি সবই তো ওজন বাড়ার পথ। এ পথ থেকে বের হতে হলে প্রথমে আমাকে বাদ দিতে হবে বাইরে খাওয়া, চিনি দেওয়া যে কোন জিনিস খাওয়া এবং অতিরিক্ত কার্বোহাইড্রেট খাওয়া। আমি কিন্তু এসব খাওয়া বন্ধ করে দেই নাই একবারে। বাইরে খাই, তবে এখন মাসে ২/৩ বার, আগে যেখানে প্রতি সপ্তাহেই ২/৩ বার বাইরে খাওয়া হত। মেয়োনেইজ, সস, কোল্ডড্রিংক্স এসব একেবারেই খাই না। মিষ্টি খাই, যদি আম্মার হাতে বানানো পিঠা হয়, তাও অল্প। আর ২/৩ দিন পরপর একবেলা ভাত ও খেয়ে ফেলি 😋 (বাঙালি না? ভাত কি ছাড়া যায় একেবারে?)। তাছাড়া মাছ, মাংস, যেভাবেই রান্না হোক না কেন, আমি খাই। আর দুধ-ডিম প্রতিদিন। আমি যেহেতু অনেক বেশি ভাত খাই(খেতাম), তাই আমি জানি আমার দৈনন্দ্যিন খাবারের তালিকা থেকে শুধু ভাত কমালেই আমার ওজন নিয়ন্ত্রণে আনা সহজ হবে (অবশ্যই ফাস্টফুড/ কোল্ডড্রিংক্স এগুলো আগে বাদ দিতে হবে, কারণ এগুলো সোজা বাংলায় বিষ, সবার জন্যই)। তবে কারো যদি শারীরিক অসুস্থ্যতা থাকে, অথবা ডায়েট করলে অসুস্থ্য হয়ে যায়, তারা অবশ্যই ডাক্তার অথবা অভিজ্ঞ কোন নিউট্রিশনিস্ট অথবা পুষ্টিবিদ এর মতামত নিয়েই ডায়েট করবেন।
গত দুই মাসে আমি হয়তো ঐশ্বর্য্য হতে পারি নাই। কিন্তু আমি এখন অনেকটা সুস্থ্য বোধ করি। এখন হাঁটতে ক্লান্তি লাগে না, সিঁড়ি দিয়ে উঠতে হাঁটু ব্যাথা হচ্ছে না, আর পায়ের তালুতে জ্বালাপোড়া অনেক কমে গেছে। জাংকফুড খাওয়া বন্ধ করার জন্য আমার স্কিনে এখন কোন র্যাশ/ ব্রণ/ এলার্জি নেই। কোন কিছু খেলেই আমার আগে পেটে গ্যাস হত, এখন গ্যাসের সমস্যা নেই বললেই চলে। আমি সুস্থ্য হবার পথে এগোচ্ছি, এখনো যেতে হবে বহুদূর...
গত দুই মাসে আমি হয়তো ঐশ্বর্য্য হতে পারি নাই। কিন্তু আমি এখন অনেকটা সুস্থ্য বোধ করি। এখন হাঁটতে ক্লান্তি লাগে না, সিঁড়ি দিয়ে উঠতে হাঁটু ব্যাথা হচ্ছে না, আর পায়ের তালুতে জ্বালাপোড়া অনেক কমে গেছে। জাংকফুড খাওয়া বন্ধ করার জন্য আমার স্কিনে এখন কোন র্যাশ/ ব্রণ/ এলার্জি নেই। কোন কিছু খেলেই আমার আগে পেটে গ্যাস হত, এখন গ্যাসের সমস্যা নেই বললেই চলে। আমি সুস্থ্য হবার পথে এগোচ্ছি, এখনো যেতে হবে বহুদূর...
***আমি কিন্তু কোন নিউট্রিশনিস্ট অথবা ডায়েটিশিয়ান না। আমার লিখার একটাই উদ্দেশ্য, কেউ যেন সুস্থ্য থাকাকে কঠিন মনে না করে... গতকাল আমাকে একজন জিজ্ঞেস করলেন, আমি নিউট্রিশনিস্ট নাকি! আমি না করলাম, তখন উনি বললেন উনি নিউট্রিশনিস্ট। আমি বললাম, "ভাল তো, কোথাও ভুল লিখলে কারেক্ট করে দিবেন"..
Great writing... Amr onk ques er answer paisi..
ReplyDeleteপরের পর্ব কবে আসবে?
ReplyDelete