ডিমখোর না-ডিম

পাড়ার এক বড় ভাইয়ের নাম নাডিম, যদিও বাবা মার দেওয়া নাম নাদিম। সেটা নাদিম থেকে নাডিম হওয়ার পেছনে দায়ী হল ডিম। কারন সে ডিম তো খায়ই না, ডিমের নাম শুনলেও ঐ এলাকায় থাকে না। কিন্তু, গল্পটা শুরু হয়েছিল অন্যভাবে।
চার-পাঁচ বছর আগেকার কথা। তখন ভাই ছিল সেই লেভেল এর ডিম প্রেমী। আমরা সাধারনত সকালের নাস্তায় ডিম খাই, আর ভাই সকাল, দুপুর, বিকাল, রাত এমন কোন বেলা নেই ডিম খেত না। ডিমের মামলেট, আধা সেদ্ধ-পুরা সেদ্ধ ডিম, ডিম পোঁচ, ডিমের চপ, ডিমের রোল, ডিমের ঝোল, ডিমের স্যান্ডউইচ, ডিম বার্গার, ডিম ভুনা, ডিমের কোরমা, ডিমের পিঠা, ডিমের হালুয়া, ডিমের পুডিং, ঝাল-মিষ্টি-টক যে কোন ভাবে ডিম, এমনকি কাঁচা ডিমও থাকত তার খাবারের মেন্যু তে। ভাতের সাথে, রুটির সাথে, পোলাওয়ের সাথে, পরোটার সাথে, নুডলসের সাথে, সুপের সাথে, সেমাইয়ের সাথে, পায়েশের সাথে, এমন কোন খাবার নেই যার সাথে ডিম খেত না নাদিম ভাই। এমনকি কারো বাসায় দাওয়াত থাকলেও শুধুমাত্র তার জন্য অন্তত একটা(!) ডিম রাখতে হত।

তখন ছিল শীতকাল। আমরা ফোর-ফাইভে পড়ি। পাড়ার ফুটবল ক্লাবের সদস্যরা মিলে ঠিক করলাম বান্দরবান যাব ঘুরতে। আমাদের সাথে যাবে আমাদের প্রাইমারী স্কুলের পিটি স্যার, কারন আমাদের একা যেতে দিতে ভরসা পাচ্ছিলো না আমাদের গার্জিয়ানরা। ঠিক করলাম ট্রেনে যাব, কারন আমরা কেউই আগে ট্রেনে চড়ি নাই। তো, সব ঠিকঠাক করে রাত ১১ টার ট্রেনের টিকেট কাটলাম।
আমরা সবাই সুপার-এক্সাইটেড ছিলাম, তাই রাত ১০ টায় সবাই স্টেশনে যেয়ে হাজির যেন ট্রেন মিস না হয়ে যায়। আবার, পিটি স্যারও বলে দিয়েছেন যেন দেরি না হয়। যদি কেউ ট্রেন মিস করে তাহলে তার বান্দরবান যাওয়া তো মিস হবেই, ট্যুর থেকে এসেই পিটি স্যার তার বারোটা বাজাবেন। যাই হোক, সেই ট্রেন আসলো বারটায়। আমরা অপার আনন্দে লাফিয়ে লাফিয়ে ট্রেনে উঠলাম।
এখন ফিরে আসি নাদিম ভাইয়ের কথায়। নাদিম ভাই ছিল আমাদের ক্লাবের সবচে সিনিয়ার। তখন পড়ত ক্লাস এইটে। ভাইয়ের সমবয়সী বন্ধু বেশি ছিল না, আমাদের সাথেই মিশত বেশি। আমরাও তার সাথে মিশতাম, কারন নিজেদের একটু বড় বড় মনে হত। আমাদের সব প্ল্যানেই নাদিম ভাই থাকতো। যথারীতি বান্দরবান ট্যুরেও আমাদের সাথে নাদিম ভাইকে নিয়েছিলাম। নাদিম ভাইকে দেখে প্রথম দর্শনেই পিটি স্যার বিরক্ত হয়ে বললেন, "এই গোবর গণেশ ভোম্বল দাস বুড়ো ধামরা, তুইও যাবি নাকি বাচ্চাদের সাথে?"
এবার আসল কথায় আসি, নাদিম ভাই নিয়ে এসেছিল দুটো ডিম সিদ্ধ, ট্রেনে খাবে বলে। নাদিম ভাই ট্রেনে উঠার ঘন্টা খানেক এর মাঝে দুটো ডিমই খেয়ে ফেললো। অস্বাভাবিক ভাবে ডিম খেতে খেতে নাদিম ভাই ডিমের মতনই গোল হয়ে গিয়েছিল। আমাদের পিটি স্যার ছিলেন আবার খুবই স্বাস্থ্য সচেতন। এমনিতেই তিনি নাদিম ভাইকে দেখে বিরক্ত ছিলেন, তারপর আবার তার অবেলা করে দুই ডিম খাওয়া দেখে ধমকে বললেন, "তোকে যেন আমি এই ট্যুরে আর একটা ডিমও না খেতে দেখি রে"। এ কথা শুনে নাদিম ভাইয়ের শুরু হলো টেনশন। সে তো যাবেই না, পারলে পরের স্টেশনেই নেমে যায়। আমরা অনেক কিছু বলে ভাই কে বুঝাইলাম, বললাম আমরা যে করেই হোক অন্তত প্রতি বেলা একটা করে ডিমের ব্যবস্থা করে দিব তাকে, অবশ্যই স্যার এর থেকে লুকিয়ে। তাকে মানাতে পারলাম ঠিকই, কিন্তু এবার আমরা পড়লাম বিপদে।
শীতকালে রাতের ট্রেন, সবাই গরম কাপর পড়ে, চাদর মুড়ি দিয়ে আরাম করে ঘুমাবো। তো, যখনই আমাদের একটু চোখ লেগে আসে ঘুমে, নাদিম ভাই আমাদের জাগিয়ে দেয়।
"ভাই ডিম এনে দিবি তো?"
"যদি না পাওয়া যায়?"
"যদি স্যার দেখে ফেলে?"
এত্তো বড় জার্নি, ঘুম তো হলোই না। ফলে যখন ভোর হলো, সব গুলো ছেলের চোখ টকটকে লাল। আর নাদিম ভাই পাগল প্রায়, চুল উস্কোখুস্কো। এক স্টেশনে ট্রেন থামল, নাদিম ভাই বললো দেখি ডিম পাওয়া যায় নাকি এখানে। সে যেই নিচে নামবে অমনি স্যার দিলেন এক হুংকার। স্যার তো ট্রেন থেক নামতেই দিবেন না। নাদিম ভাই বললো নাস্তা আনতে যাচ্ছে, এ কথা শুনে স্যার বললেন, "পরের স্টেশনে আমি নাস্তা এনে দিব। কারো ট্রেন থেকে নামা-নামি নাই"। একথা শুনে নাদিম ভাই এর তো প্রাণ আসে আর যায়। ট্রেন থেকে না নামলে, ডিম পাবে কই? এত সকালে তো কোন ডিমের ফেরিওলাও আসছে না।
পরের স্টেশন আসলে স্যার নাস্তা নিয়ে আসলেন। নাস্তা করার একটু পর স্যার এর চোখ লেগে গেল। তখন এক ডিমওলা আসল, নাদিম ভাই ইশারায় ডাকল তাকে, যেই ডিম নিতে যাবে ঠিক তখনই স্যারের ঘুম ভেঙ্গে গেল, আর ডিমলাকে এক হুঙ্কার দিয়ে বিদায় করে দিল। বেচারা নাদিম ভাইয়ের ভাঙ্গা মনটাকে যেন সুপার গ্লু দিয়ে লাগিয়ে আবারও ভেঙ্গে দিল। আমরাও স্যারের ভয়ে কিছুই করতে পারছিলাম না। ভাই অসহায় হয়ে একবার আমাদের দিকে তাকায়, একবার আড় চোখে স্যার কে দেখে। তখন আমার মাথায় একটা বুদ্ধি আসল। চুপিচুপি নাদিম ভাইকে বললাম, "ভাই ট্রেনেও তো ক্যান্টিন থাকে, ওখানে ডিম পাওয়া যেতে পারে। তুমি বাথরুমে যাবা বলে ওখান থেকে ঘুরে আসো"। নাদিম ভাইয়ের চোখ টা আনন্দে ঝিলিক দিয়ে উঠল। বেচারা অতি উৎসাহে ক্লাসরুমের মতন করেই স্যার কে বলে ফেললো, "স্যার একটু টয়লেটে যেতে পারি? স্যার ইমারজেন্সি, দুই নাম্বার"। স্যার রাগে চোখ কটমট করে বলে, "গেলি তুই?"
তারপর, নাদিম ভাই এর খোঁজ খবর নাই অনেকক্ষণ। আধা ঘন্টা মতন পার হবার পর স্যার আমাকে আর বিল্টু কে পাঠালো ভাইকে খুঁজতে। আমরা ক্যান্টিন পর্যন্ত যাওয়ার আগেই দেখি নাদিম ভাই একটা সিটের পাশে দাঁড়িয়ে কাদের সাথে যেন কথা বলছে। নাদিম ভাই কে যখনই ডাক দিতে যাব, নাদিম ভাই আমাদের দিকে ঘুড়েই এক দৌড়। দেখি নাদিম ভাইয়ের মুখের ভেতরটা ভর্তি যেন কি। যাদের সাথে নাদিম ভাই কথা বলছিল, একজন মহিলা আর দুটো বাচ্চা ছেলে, ওরাও উঠে এক দৌড় দিল নাদিম ভাইয়ের পিছনে। এই দেখে আমি আর বিল্টু ও ওদের পিছন পিছন দৌড়। পড়ি মড়ি করে দৌড় দিয়ে দেখি ঐ মহিলা নাদিম ভাইয়ের কান টেনে ধরেছেন, আর নাদিম ভাইকে জিজ্ঞেস করছে, "এই ছেলে তোমার বাবা মা কোথায়, কার সাথে আসছ? এক্ষুনি নিয়ে চল আমাকে তোমার গার্জিয়ানের কাছে, নয়তো পুলিশে দিব"।হ
নাদিম ভাই তখন নিরুপায় হয়ে তাদের নিয়ে গেল স্যারের কাছে। স্যারের কাছে যেয়েই ভদ্রমহিলা রাগে ফোঁস ফোঁস করে বললেন, "এই ছেলে আমার ছেলেদের ডিম নিয়ে দৌড় দিয়েছে"। নাদিম ভাই তখনই ঢোক চিপে মুখের ডিম টুক গিলে ফেললো। পরে ভয়ে কাচুমাচু হয়ে আমতা আমতা করে বলল, "আমি তো কোথাও ডিম পেলাম না, ওদের দেখলাম ডিম খাচ্ছে। দুটো ছোট ছোট ছেলে কি আর দুটো ডিম খেতে পারবে? আমি তাই একটা খেয়ে ফেললাম। আমি তো ওদেরকে জিজ্ঞেস ও করেছিলাম যে ওরা খেতে পারবে নাকি। এই বাবু তোমাকে জিজ্ঞেস করি নি?"
এই কথা শুনে ঐ মহিলা আর স্যার তো অগ্নি দৃষ্টি তো দিলই, এমনকি ঐ পিচ্চি গুলোও অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো নাদিম ভাইয়ের উদ্দেশ্যে। এইবার নাদিম ভাই আর যাবে কই!
স্যার বলল, "দাড়া, তোর ডিম খাওয়া আমি বের করছি"।
এই বলে স্যার তক্ষুনি এক ডিমওলা কে জোগাড় করলো, তারপর নাদিম ভাইকে বললো "তুই এই সব ডিম খেয়ে শেষ করবি এখন, নয়তো ডিম তোর নাক আর কান দিয়ে খাওয়াবো আমি"। নাদিম ভাই জানে স্যার কেমন রাগী, তাই কোনরূপ উচ্চ-বাচ্য না করে ডিম খাওয়া শুরু করলো। স্যারও ওকে ডিম খাওয়া বন্ধ করতে দিলনা যতক্ষন পর্যন্ত ও বমি করে সব ফেলে দেয়। ততক্ষণে স্যার ঐ ভদ্রমহিলাকে সরি-টরি বলে বিদায় দিয়ে দিয়েছেন।
এরপরে নাদিম ভাই আর কখনোই ডিম খেতে চায় নি, কোন ভাবেই আর তাকে ডিম খাওয়ানো যায় নি। আর তারপর থেকেই তার নাম হলো না-ডিম।

Comments

Post a Comment

Popular posts from this blog

মেটাবোলিজম

বই পড়াঃ ১ম পর্ব

ভুতের গল্পঃ ১ম পর্ব

ডায়েট/ক্রাশ ডায়েট